ভারতে বাংলাদেশ নিয়ে অপপ্রচার ও ত্রিপুরায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলার জবাব দিতে সরকারকে সমর্থন জানিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। বাংলাদেশ দুর্বল শক্তিহীন নতজানু নয়– এ বার্তা দিতে সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে জাতীয় ঐক্য থাকবে। ঐক্য প্রদর্শনে হবে সমাবেশ। লাগাতার উস্কানিতেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রাখতে যে কোনো পক্ষের চরমপন্থা দমন করা হবে। সংখ্যালঘু নির্যাতনের গুজবেরও জবাব দেওয়া হবে।
গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে। ভারতীয় অপপ্রচার মোকাবিলায় সরকারকে সহায়তায় রাজনৈতিক পরিষদ বা নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করা যায় কিনা, তা খতিয়ে দেখারও প্রস্তাব করা হয় বৈঠকে। ১৫টি দল ও জোটের নেতারা এতে অংশ নেন।
প্রস্তাব আসে জাতীয় পতাকা হাতে সব রাজনৈতিক দল, সংগঠন, পেশাজীবীসহ সাধারণ মানুষকে নিয়ে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কর্মসূচি করবে। এর মাধ্যমে পুরো বিশ্বকে দেখাতে হবে– বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই।
বৈঠকে সরকারপ্রধান ভারতের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘বারে বারে তাদের বলছি, আপনারা আসুন, বাধা নেই। কিন্তু না, তারা ওখান থেকেই কল্পকাহিনি বানিয়ে যাচ্ছে। এখন সারা দুনিয়াকে বলতে হবে, আমরা এক, যেটা পেয়েছি (৫ আগস্ট), একজোট হয়ে পেয়েছি, যারা আমাদের ওপর চেপে ছিল, তাদের উপড়ে ফেলেছি।’
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের চেতনায় জাতি এখনও উজ্জীবিত ও ঐক্যবদ্ধ মন্তব্য করে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আগে একটা মারলে ৪টা দাঁড়াত, এখন একটা মারলে ৪০টা দাঁড়াবে।
বৈঠক সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুতদের প্রতি কঠোর হতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। সরকারে থাকা তাদের দোসরদের সরিয়ে দেওয়া, ভারতীয় অপপ্রচারের বিরুদ্ধে প্রেস উইংকে সক্রিয় করা, সাম্প্রদায়িক গুজব খণ্ডন করা এবং শান্তি রক্ষায় কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন নেতারা।
বৈঠকে বিএনপির পক্ষে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার প্রস্তাব করেন। সবাই মিলে ষড়যন্ত্র মোকাবিলার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, পতিত সরকার বিদেশে গিয়ে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। বিদেশে যেসব দেশ সেই পতিত সরকারকে সহযোগিতা করছে, তাদের বিরুদ্ধে সবাই ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন।
ষড়যন্ত্র হচ্ছে এবং বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা হচ্ছে উল্লেখ করে খন্দকার মোশাররফ বলেন, জনগণ যেমনভাবে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় করেছে; তাদের সহযোগিতাকারী ও তাদের ষড়যন্ত্রকে সেভাবে সবাই মিলে মোকাবিলা করা হবে।
জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, চরমপন্থা যেদিক থেকে আসবে, তাকে ঘৃণা করি, প্রশ্রয় দেব না, মেনেও নেব না। এ ব্যাপারে সবাই একমত হয়েছি।
বৈঠক সূত্র জানায়, গণঅধিকার পরিষদের একাংশের সভাপতি নুরুল হক নুর জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব করলেও অন্যরা তা সমর্থন করেননি। এবি পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু জাতীয় ঐক্য প্রদর্শনে সংহতি কর্মসূচির প্রস্তাব করলে সব দল তাতে সমর্থন জানায়।
সিপিবি, বাসদ, বাংলাদেশ জাসদ বৈঠকে আমন্ত্রণ পেলেও ডাক পায়নি জাতীয় পার্টি। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দল শরিকদেরও ডাকা হয়নি। এলডিপিকে আমন্ত্রণ করা হলেও অতিথি তালিকায় নাম না থাকায় ক্ষুব্ধ হয়ে দলটির প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বৈঠকে যোগ দেননি।
বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ব্রিফিংয়ে বলেন, আদর্শিক ভিন্নতা থাকলেও সবাই সার্বভৌমত্ব, অস্তিত্ব, স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। সব সম্প্রদায়ের মানুষের ভূমিকার প্রশংসা করা হয়েছে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যে কোনো উস্কানির মুখে অটুট রাখার কথা বলা হয়েছে।
উপদেষ্টা বলেন, গোটা জাতি ভারতের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। এ জন্য সবাই মিলে একটি সমাবেশ করতে পারি কিনা, রাজনৈতিক সম্মেলন করতে পারি কিনা, এমনকি নিরাপত্তা সম্মেলন করতে পারি কিনা এই প্রস্তাব আনা হয়েছে। বাংলাদেশ দুর্বল, শক্তিহীন, নতজানু নয়– এই বার্তা প্রকাশ করতে এবং জানিয়ে দিতে বলা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা বৈঠকে বলেছেন, আমাদের স্বাধীনতা অনেকের পছন্দ হচ্ছে না। ৫ আগস্টের পর থেকে নানাভাবে একে উল্টে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। সারাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গাপূজা হয়েছে। কোথাও বিশৃঙ্খলা হয়নি। সেটাও অনেকের পছন্দ হয়নি। দেশকে অস্থির করার চেষ্টা চলছে।
ভারত এবং আওয়ামী লীগের প্রতি ইঙ্গিত করে সরকারপ্রধান বলেছেন, ‘যে বাংলাদেশ আমরা গড়ার চেষ্টা করছি, তা ধামাচাপা দিয়ে আরেক বাংলাদেশের কাহিনি রচনা করে যাচ্ছে। সারাক্ষণ নানা রূপে তারা এটা করে যাচ্ছে। এটা যে এখন এক দেশের মধ্যে আছে তা নয়, বিশেষ বিশেষ বড় দেশের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে একটি শক্তি ভয়ংকর হিসেবে দেখাতে চায় বলে মন্তব্য করেন ড. ইউনূস। শান্তিতে নোবেলজয়ী এই অধ্যাপক বলেছেন, ‘অভ্যুত্থান যাদের পছন্দ হয়নি, তারা একে মুছে দিতে চায়, এখানে নাকি ভয়ংকর কাণ্ড ঘটছে, তা থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হবে। রক্ষার জন্য তারা এগিয়ে আসতে চায়। এখন সেগুলোকে মিথ্যা প্রমাণ করা বা বাস্তবতাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমাদের সবাইকে একজোট হতে হবে। জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বের বিষয়।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘মুখে বলছে না, কিন্তু ভঙ্গি হলো আগেরটা (আওয়ামী শাসন) ভালো ছিল। তাদের শক্তি এত বেশি যে, তারা মানুষকে এর ভেতরে ভেড়াতে পারছে। তাদের কল্পকাহিনির কারণে মানুষ সন্দেহ প্রকাশ করছে যে, এটা কী ধরনের সরকার হলো।’
রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশে ড. ইউনূস বলেন, ‘আপনারা সবাই ভালো বোঝেন। সবাই মিলে আমরা একজোট হয়ে যেন কাজটা করতে পারি, সবাই একত্র হয়ে বললে একটা সমবেত শক্তি তৈরি হয়।’
অভ্যুত্থান রক্ষায় গত ২৭ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয় বিএনপি। পরের দিন এ আহ্বানে সাড়া দেওয়ার কথা জানায় জামায়াতসহ অন্যান্য দল। গতকালের বৈঠকে সব দল থেকে একজন করে মতামত জানান।
প্রস্তাব আসে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঐক্যের আহ্বানে জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ দেওয়া উচিত। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন করে পরিস্থিতির মূল্যায়নে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নিরাপত্তা ও অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব দল ও সরকারের মধ্যে জাতীয় ঐক্যের দলিল প্রণয়ন করতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাসহ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করতে হবে।
বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রতিষ্ঠিত। তাদের দায়িত্ব স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। দেশের বিরুদ্ধে পতিত সরকার বিদেশ থেকে ষড়যন্ত্র করছে। জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্য অপচেষ্টা হচ্ছে; তা মোকাবিলায় ঐক্যের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ভারতের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশী সুলভ সম্পর্ক চাই। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তাদের ভূমিকা উস্কানিমূলক। মিথ্যা তথ্যে বাংলাদেশকে কলুষিত করতে, জনগণ ও সরকারকে ব্যর্থ করতে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, প্রস্তাব এসেছে ভারতের সঙ্গে চুক্তি পর্যালোচনার এবং জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি চুক্তি বাতিলের। সরকার এ বিষয়ে একমত হয়েছে। বাংলাদেশ কারও কাছে মাথানত করবে না।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ঐক্যের প্রকাশ হিসেবে সারাদেশে জাতীয় পতাকা হাতে আমরা দাঁড়াব।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা আদিলুর রহমান, মাহফুজ আলম, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও অধ্যাপক এ জেড এম জাহিদ হোসেন, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মুহাম্মদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, ভাসানী অনুসারী পরিষদের রফিকুল ইসলাম বাবলু, ১২ দলীয় জোটের মোস্তফা জামাল হায়দার, বাংলাদেশ এলডিপি সভাপতি শাহাদাত হোসেন সেলিম, জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা, খেলাফত মজলিসের আবদুল বাসিত আজাদ, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি, এনপিপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ প্রমুখ।