
বাংলাদেশে প্রতি চারজন নারীর মধ্যে তিনজনই (৭৬ শতাংশ) জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে জীবনসঙ্গী বা স্বামীর দ্বারা সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এমন উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) যৌথ জরিপে। এই সহিংসতার মধ্যে রয়েছে শারীরিক, যৌন, মানসিক, অর্থনৈতিক সহিংসতা এবং নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ।
সোমবার সকালে রাজধানীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ‘নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ ২০২৪’-এর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
জরিপে জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী সহিংস আচরণের পাশাপাশি বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান নানা প্রকার সহিংসতামূলক আচরণও পরিমাপ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, এই জরিপের লক্ষ্য হলো নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে একটি বাস্তবমুখী কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা, যেখানে সহিংসতা প্রতিরোধে বিনিয়োগ, আইনি সহায়তা, জেন্ডার সমতা এবং মানবাধিকারের ভিত্তিতে সহায়ক নীতিমালা প্রণয়নের আহ্বান জানানো হয়েছে।
জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, দেশের ৭৬ শতাংশ নারী জীবনে অন্তত একবার স্বামীর সহিংসতার শিকার হয়েছেন। উদ্বেগজনকভাবে, ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৬২ শতাংশ কখনোই তাদের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেননি।
নন-পার্টনার (যিনি স্বামী বা প্রাক্তন স্বামী নন) কর্তৃক সহিংসতার বিষয়েও তথ্য উঠে এসেছে এই জরিপে। যেখানে দেখা গেছে, ১৫ বছর বয়স থেকে ১৫ শতাংশ নারী নন-পার্টনারের হাতে শারীরিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এবং ২.২ শতাংশ যৌন সহিংসতার শিকার।
তবে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনও দেখা গেছে। ২০১৫ সালের তুলনায় স্বামী কর্তৃক সহিংসতার হার কিছুটা কমে এসেছে। ২০১৫ সালে যেখানে হার ছিল ৬৬ শতাংশ, ২০২৪ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৯ শতাংশে।
তবুও চিকিৎসা ও আইনি সহায়তা নিতে এখনো নারীদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। অন্যদিকে, সামাজিক কুসংস্কার ও ভয়ের কারণে অনেক নারী সহিংসতার পরও নীরব থাকছেন।
জরিপের বিস্তারিত বিশ্লেষণে উঠে এসেছে
অর্ধেকেরও বেশি নারী (৫৪ শতাংশ) জীবদ্দশায় স্বামীর দ্বারা শারীরিক বা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
যৌন সহিংসতার শিকার নারীদের ৬০ শতাংশ গত এক বছরে একাধিকবার এ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন।
গর্ভাবস্থায় ৭.২ শতাংশ নারী শারীরিক এবং ৫.৩ শতাংশ যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন, যা মা ও শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
নন-পার্টনার কর্তৃক সহিংসতার মধ্যে শাশুড়ি ও পুরুষ আত্মীয়দের সম্পৃক্ততা সবচেয়ে বেশি। অপরদিকে, নন-পার্টনার যৌন সহিংসতার ঘটনাগুলোর বেশিরভাগ ঘটেছে পরিচিতজনদের দ্বারা— যেমন বন্ধু, আত্মীয় বা পরিচিত পুরুষদের মাধ্যমে।
প্রযুক্তিনির্ভর সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৮.৩ শতাংশ নারী। যার মধ্যে যৌন ব্ল্যাকমেইল, ছবি বা ভিডিওর অপব্যবহার, এবং অনলাইন নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ অন্তর্ভুক্ত।
সহায়তা পাওয়ার হারও আশঙ্কাজনকভাবে কম। মাত্র ১৪.৫ শতাংশ ভুক্তভোগী চিকিৎসা নিয়েছেন, আর আইনি পদক্ষেপ নিয়েছেন ৭.৪ শতাংশ নারী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা স্থানীয় নেতাদের দ্বারস্থ হয়েছেন। অন্যদিকে, নন-পার্টনার সহিংসতায় আক্রান্ত নারীদের মধ্যে ৩.৮ শতাংশ আইনি পদক্ষেপ নিয়েছেন, যাঁদের অধিকাংশ পুলিশের কাছে সহায়তা চেয়েছেন।
জরিপে আরও বলা হয়, দেশের মাত্র ৪৮.৫ শতাংশ নারী জানেন কোথায় সহিংসতার অভিযোগ জানাতে হয়। আর ১০৯ হেল্পলাইন সম্পর্কে জানেন মাত্র ১২.৩ শতাংশ নারী।
সহিংসতার ঝুঁকি বাড়ায়: কম বয়স, যৌতুক প্রথা, স্বামীর মাদকাসক্তি, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক এবং শহুরে বস্তি জীবনযাপন। অপরদিকে, স্বামীর উচ্চতর শিক্ষা সহিংসতার ঝুঁকি কমায় বলে জরিপে দেখানো হয়েছে।
নন-পার্টনার সহিংসতার ক্ষেত্রে নারীর অল্প বয়স, সীমিত শিক্ষা এবং প্রতিবন্ধিতা বড় ঝুঁকির কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এই জরিপে।