দেশের প্রকৃত মূল্যস্ফীতির হার এখন ১৫ থেকে ১৭ শতাংশের মধ্যে বলে মনে করে শ্বেতপত্র কমিটি। অভিজ্ঞতাভিত্তিক ও খসড়া হিসাবের ভিত্তিতে তারা এই পরিসংখ্যান দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
শ্বেতপত্র কমিটি বলছে, চলতি বছরের এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি ছিল ১৫ শতাংশ, মে মাসে ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ, জুনে ১৫ শতাংশ, জুলাইয়ে ১৮ দশমিক ১ শতাংশ, আগস্টে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ ও সেপ্টেম্বর মাসে ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ। ফলে দরিদ্র মানুষের জীবনে এর চরম অভিঘাত পড়ছে। বিভিন্ন সময় সরকারি ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদনেও দেখা গেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে।
কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাস্তবে মূল্যস্ফীতির হার সরকারি পরিসংখ্যানের চেয়ে বেশি। ২০২৪ সালে সরকারি সংস্থা বিআইডিএস ও ২০২২–২৩ সালে সানেমের জরিপেও এই বিষয়ের সত্যতা উঠে এসেছে। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে সরকারি পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাস্তবতার ফারাক বেশি। এতে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির হারেও প্রভাব পড়েছে।
তবে শ্বেতপত্র কমিটি মনে করে মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান যে ইচ্ছাকৃতভাবেই কম করে দেখানো হতো, বিষয়টি সে রকম না–ও হতে পারে। বিষয়টি সম্পর্কে তারা ঠিক পরিষ্কারভাবে কিছু বলেনি। বিবিএসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে শ্বেতপত্র কমিটির মনে হয়েছে, বিগত সরকারের আমলে মূল্যস্ফীতির অদৃশ্য উচ্চ সীমা ছিল ১০ শতাংশ, এটা মনে করা ভিত্তিহীন নয়। এ ছাড়া পদ্ধতিগত সমস্যা তো আছেই।
দেশে যে মূল্যস্ফীতির প্রকৃত চিত্র সরকারি পরিসংখ্যানে প্রতিফলিত হচ্ছে না, তার সপক্ষে বেশ কিছু উদাহরণ দিয়েছে শ্বেতপত্র কমিটি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) হিসাবে দেখা যায়, সেই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৫ শতাংশ। যদিও সেই মাসে বিবিএসের হিসাব ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। এ ছাড়া বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বেশ কিছু নিত্যপণ্যের বাজারমূল্য হিসাব করে দেখিয়েছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের গ্রামাঞ্চলের খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৭ শতাংশ। যদিও এই সময় সরকারি হিসাব হচ্ছে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি একধরনের অদৃশ্য ঘাতক। সমাজের সচ্ছল ও ধনী মানুষের ওপর এর তেমন প্রভাব না পড়লেও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর এর প্রভাব ব্যাপক। যে মানুষেরা কোনোভাবে নাক ভাসিয়ে দারিদ্র্যসীমার ওপর ভেসে থাকে, তারা মূল্যস্ফীতির কারণে যেকোনো সময় দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে।
শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও কোভিড-১৯-এর প্রভাবে দেশের ২৭ লাখ ৫১ হাজার মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গিয়েছিলেন। বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবে, ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ চরম দরিদ্র হয়ে যায়। আরও প্রায় ৮ লাখ ৪০ হাজার মানুষ কোনোমতে দারিদ্র্যসীমার ওপর বেঁচে থাকা মানুষের কাতারে নেমে যান। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যের কথা বলেছে বিশ্ব ব্যাংক। গরিব পরিবারের ব্যয়ের অর্ধেক হয় খাদ্য বাবদ, সে কারণে খাদ্যের দাম বাড়লে দরিদ্র পরিবারগুলো সবচেয়ে আক্রান্ত হয়।
শ্বেতপত্র কমিটি মনে করছে, বিশ্ববাজারে খাদ্যমূল্য কমলেও দেশের বাজারে না কমার কারণ হলো, টাকার অবমূল্যায়ন, রিজার্ভ সংকটের কারণে আমদানিতে সীমাবদ্ধতা, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, বাজারের অব্যবস্থাপনা, করপোরেট মুনাফা বৃদ্ধির তাগিদ ইত্যাদি। এ ছাড়া নীতি সুদহার বৃদ্ধি করা সত্ত্বেও ব্যাংক ঋণের প্রকৃত সুদহার একটা সময় পর্যন্ত বাড়ানো হয়নি। ফলে মুদ্রানীতির প্রভাব বাজারে সেই অর্থে পড়েনি।
এই বাস্তবতায় মানুষকে স্বস্তি দিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে শ্বেতপত্র কমিটি। ২০২৫ সালে চরম দরিদ্র মানুষদের জন্য নগদ সহায়তা কর্মসূচিতে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলেছে কমিটি। সেই সঙ্গে কর ছাড় দেওয়ার কথাও বলেছে তারা।