
দেশ তখন সামরিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ক্ষমতার অংশীদার হতে তৎপর। শহিদজননী জাহানারা ইমামের শরীরে তখন বাসা বেঁধেছে মারণব্যাধি ক্যানসার। তবু দমে যাননি তিনি। একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে, তাদের বিচার-প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার দাবিতে তারুণ্যের সংযুক্তিতে আরও তৎপর হলেন তিনি। বিগত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে তার নেতৃত্বেই গড়ে ওঠে জনতার গণ-আদালত; যে আদালতে ফাঁসি ঘোষণা করা হয় একাত্তরের শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের।
আজ ২৬ জুন শহিদজননীর জাহানার ইমামের ৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৪ সালের আজকের দিনে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যের ডেট্রয়েটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার জীবনাবসান ঘটে। ১৯২৯ সালের ৩ মে অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে জাহানারা ইমাম জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর পেশা হিসেবে বেছে নেন অধ্যাপনা।
জাহানারা ইমামের বড় সন্তান শাফী ইমাম রুমী। একাত্তরের মার্চে যুদ্ধের দামামা যখন বাজছে, তখন রুমী বিভিন্ন সভা-সমিতিতে যেতে শুরু করেন। জাহানারা ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইতে লিখে গেছেন সেসব দিনের কথা। ছেলেকে যুদ্ধে পাঠিয়েই কর্তব্য শেষ হয়নি জাহানারা ইমামের। স্বামী প্রকৌশলী শরীফ ইমামকে নিয়ে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের বাড়ি ‘কণিকা’কে গড়ে তোলেন মুক্তিযোদ্ধাদের পরম আশ্রয়স্থল হিসেবে। এই বাড়ি থেকে যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হতো, তেমনি আবার দুর্ধর্ষ সব অভিযানের পরিকল্পনাও হয়েছে এই বাড়িতে বসে।
একাত্তরের ২৯ আগস্ট জাহানারা ইমাম হারান তার ছেলে রুমীকে। ওই রাতে বেশকিছু গেরিলা যোদ্ধার সঙ্গে রুমী পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। আর ফিরে আসেননি তিনি। ওই বছরের ১৩ ডিসেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান জাহানারার স্বামী শরীফ ইমাম। স্বামী-ছেলেকে হারিয়েও জাহানারা ইমাম থেমে যাননি। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জনগণকে একতাবদ্ধ করে তুলতে তিনি আবার পথে নামেন। ১৯৯২ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক হন। এ সময় একাত্তরের ঘাতক ও দালালদের বিচারের দাবিতে গড়ে তোলা হয় গণ-আদালত। সেই আদালতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীণ আমির গোলাম আযমের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন ১২ জন বিচারক। এই গণ-আদালত পরিচালনায় দায়ে জাহানারা ইমাম ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে মামলা করা হয়। পরে উচ্চ আদালতের রায়ে জামিন পেয়ে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আবারও সোচ্চার হন। ১৯৯৩ সালের ২৮ মার্চ একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সমাবেশে পুলিশ লাঠিপেটা করে। এতে শহিদজননী জাহানারা ইমাম আহত হয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (তৎকালীন পিজি হাসপাতাল) ভর্তি হন। তখন তার সেই আন্দোলনের রেশ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির আন্দোলনকে সমর্থন দেয় ইউরোপীয় পার্লামেন্ট।
জাহানারা ইমামের লেখা বিভিন্ন বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘অন্য জীবন’, ‘বীরশ্রেষ্ঠ’, ‘জীবন মৃত্যু’, ‘চিরায়ত সাহিত্য’, ‘বুকের ভেতরে আগুন’, ‘নাটকের অবসান’, ‘নিঃসঙ্গ পাইন’, ‘নয় এ মধুর খেলা’, ‘ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস’ ও ‘প্রবাসের দিনলিপি’।