
রংপুরে একটি পার্কে চাঁদা দাবির অভিযোগ ওঠা বৈষম্যবিরোধী নেতার পক্ষে এবার সংবাদ সম্মেলন করেছেন আজহারুল ইসলাম ভূঁইয়া নামের এক ব্যক্তি। সংবাদ সম্মেলনে তিনি দাবি করেছেন, ইকোপার্ক নির্মাণ ও অবৈধ বালু উত্তোলন নিয়ে যে জমিটির বিষয়ে আলোচনা উঠেছে, সে জমির মূল মালিক তিনি। তার জমি দখল হওয়ায় তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতাদের দ্বারস্থ হয়েছেন। ছাত্র নেতাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা অপ্রচার; বরং ওই নেতারা অর্থের প্রলোভন অগ্রাহ্য করে সেখান থেকে চলে আসেন।
রোববার (২ মার্চ) রংপুর নগরীর সুমি কমিউনিটি সেন্টারে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে এই সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন আজহারুল ইসলাম।
জমির মালিকানা দাবি করা আজহারুল ইসলাম রংপুর নগরীর কেরানীপাড়ার বাসিন্দা। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, গংগাচড়ার পূর্ব খলেয়া মৌজায় তার ৪ একর ৫৯ শতাংশ জমি আছে। ২০১৯ সালে তার ভাই আতিকুল ইসলাম ও মঞ্জুরুল ইসলাম গং জাল রিটের মাধ্যমে জমিটি দখল করেন। জাল চুক্তি সংগ্রহ করে তিনি আদালতে মামলা করলে আদালত সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের জন্য সিআইডিতে প্রেরণ করেন। পরবর্তী সময়ে সিআইডির তদন্তে জালিয়াতি প্রমাণিত হয়। মামলাটি আদালতে চলমান কিন্তু রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাব খাটিয়ে তার ভাইয়েরা জমি থেকে বালু উত্তোলন করে আসছেন। তিনি কয়েক দফা প্রশাসনে অভিযোগ করেছেন, অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে কয়েক দফা জরিমানাও করা হয়। কিন্তু তিনি জমি উদ্ধার করতে পারেননি। অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি।
আজহারুলের দাবি, অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রংপুরের নেতাদের দ্বারস্থ হন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ঘটনাস্থলে যান। সেখানে আতিকুল ইসলাম তার গুন্ডা বাহিনী দিয়ে বৈষম্যবিরোধী নেতাদের অনৈতিক অর্থের প্রলোভন দেখান। বৈষম্যবিরোধী নেতারা তাদের প্রলোভন অগ্রাহ্য করে সেখান থেকে বের হয়ে আসেন। এ সময় গোপন কথোপকথনের ভিডিও ধারণ করা হয় যা পরে এডিটিং করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চাঁদাবাজির ভিডিও বলে প্রচার করা হচ্ছে।
লিখিত বক্তব্য শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে এড়িয়ে গিয়ে বারবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের পক্ষে নিজের অবস্থান তুলে ধরে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে সাংবাদিকদের সহযোগিতা কামনা করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আজহারুলের অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেন তার ছোট ভাই আতিকুল ইসলাম। পারিবারিক ঘটনা হওয়ায় এসব প্রকাশ করতে চাননি উল্লেখ করে আতিকুল ইসলাম জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা নাহিদ হাসান খন্দকার পার্কে চাঁদা দাবি করতে গিয়েছিলেন। তিনি পুলিশ সুপারের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছেন। শিগগির আইনি ব্যবস্থা নেবেন।
এর আগে, শনিবার (১ মার্চ) সকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রংপুর মহানগর কমিটির মুখপাত্র নাহিদ হাসান খন্দকারের একটি ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওই ভিডিওতে রংপুর নগরীর গ্রিন সিটি ইকো পার্কের প্রকল্প ব্যবস্থাপক বেলাল হোসেনের সঙ্গে নাহিদ হাসানের কথোপকথন শোনা যায়।
এতে নাহিদ হাসানকে বলতে শোনা যায়, ‘আপনি তো দেখছেন বিষয়টি কোথায় গেছে। আপনি কথা বলেন, যদি আপনার মনে হয় একটু ইয়া করবেন, একটা সংগঠন করতে গেলে কী করতে হয় আপনি তো জানেন। এ হচ্ছে কথা। আমি চাচ্ছি না আপনার কোনো সমস্যা হোক। যদি আপনাদের দিক থেকে মনে হয় কোনো সমস্যা হচ্ছে, তাহলে আপনি ভাইয়ের (পার্ক কর্তৃপক্ষ) সঙ্গে কথা বলেন। আপনাদের গলায় পাড়া দিয়ে আমি কিছু করতে পারব না।’
পার্ক ম্যানেজার ১ লাখ টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ৫ হাজার টাকা দেওয়ার কথা বলেন। এ সময় নাহিদ তাদের আরও সময় নেওয়ার কথা বলেন।
এদিকে চাঁদা দাবির ভিডিওর পর শনিবার রাতে নাহিদ হাসান খন্দকারের সঙ্গে গ্রিন সিটি ইকোপার্কের প্রকল্প ব্যবস্থাপক বেলাল হোসেনের আলাপচারিতার চারটি কল রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
এসব কল রেকর্ডে নাহিদ হাসান খন্দকার পার্কের ব্যবস্থাপক বেলাল হোসেনকে মুঠোফোনে বলেন, ‘ডিসি আমাকে রাতে ফোন করেছিল, তারা কোনো স্টেপ নেবে কি না। আমি তাকে বলেছি, আমরা তাদের সঙ্গে (পার্ক মালিক) কথা বলছি। আমরা প্রতিদিন ২০ হাজার টাকা দাবি করছি এবং ১ লাখ টাকা চাইছি বলে আপনাদের লোক বিচার দিছে। আমার মনে হয় সবকিছু আটকায় দেওয়া ভুল হয়েছে। রাতেই আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
কথোপকথনে পার্কের ব্যবস্থাপক বেলাল হোসেন বলেন, ‘তুমি যেটা চাইছো, তোমার জায়গা থেকে। আওয়ামী লীগ চলে গেছে, ভেবেছি জ্বালা গেল। এখন এটা আবার নতুন করে তৈরি হয়েছে। তুমি ১ লাখ টাকা চেয়েছ, এটা আমাদের দেওয়া সম্ভব না। আমাদের এক পয়সা ইনকাম নাই।’
এদিকে এসব কল রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রংপুরের মুখপাত্র নাহিদ হাসান খন্দকারকে নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। যদিও চাঁদা দাবির বিষয়টি অস্বীকার করেছেন নাহিদ হাসান খন্দকার।
নিজেকে নির্দোষ দাবি করে নাহিদ হাসান বলেন, কয়েক দিন (তিন-চার) আগে আমরা জানতে পারি একটি পার্কে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। আমরা সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ৭-৮ জনের একটি টিম সেখানে গিয়ে দেখতে পাই বালু উত্তোলন করে ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমরা তাদের কাছে জানতে পারি পার্কের ভেতরে পুকুর খনন করে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। সেখানে আমরা একটি রিপোর্ট করি এবং বেশ কিছু ভিডিও করে রাখি। সেখানকার একজন মুরুব্বি বেলাল নামের একজনকে ফোন দেন। বেলাল বিএনপির পরিচয় দিয়ে আমাকে শিমুলবাগ কমিউনিটি সেন্টারে ডাকে। তাদের ১০-১২ জনের একটি টিম আমার কাছে আসে। তারা কথাবার্তার মাঝে আমাদেরকে বিভিন্নভাবে অর্থের প্রলোভন দেখায়। আমরা সেটি এড়ানোর চেষ্টা করে দ্রুত সেখান থেকে চলে আসি।
নাহিদ আরও বলেন, ‘কেউ যদি প্রমাণ করতে পারে আমরা সেখান থেকে এক টাকা নিয়েছি, তাহলে সংগঠন যে শাস্তি দিবে তা আমি মাথা পেতে নেব। আমি সেখানে পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাইরে মিটিং আছে বলে চলে আসার চেষ্টা করেছি। আমরা যেন তাদের ব্যবসায় হাত দিতে না পারি সেজন্য আমার বিরুদ্ধে অনৈতিকভাবে এআইয়ের মাধ্যমে ভিডিও তৈরি করেছে। যারা এই ভিডিও ছড়িয়েছে তারা আওয়ামী লীগের দোসর। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা ফ্যাসিস্টদের সরিয়েছি, এখন সেই ফ্যাসিস্টদের দোসররা আমাদেরকে বিভিন্নভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোনো প্রকার অবৈধ কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দেয় না উল্লেখ করে সংগঠন থেকে নাহিদ হাসান খন্দকারকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। শনিবার রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রংপুর মহানগরের মুখ্য সংগঠক আলী মিলনের স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে তিন দিনের মধ্যে তার বিরুদ্ধে কেন সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
এ ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রংপুর মহানগর কমিটির আহ্বায়ক ইমতিয়াজ আহমেদ ইমতি বলেন, যে ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে সেটি নিয়ে আমাদের টিম তদন্ত করছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে কেউ তাকেসহ আমাদের প্ল্যাটফর্মকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য এমন ঘটনা ঘটিয়েছে। ইতোমধ্যেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বাংলাদেশের নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের পেজে এসব বেশি প্রচার করা হচ্ছে। এসব আমাদের কাছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে তৈরি বলে মনে হচ্ছে। তবে তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে সেটির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা শোকজের মাধ্যমে তার জবাব জানতে চাওয়া হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।