সেতু বিভাগে নতুন সচিব নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে ও প্রশাসনের রেওয়াজ ভেঙে ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর রশিদুল হাসানকে (পরিচিতি নম্বর-৭৬৩৭) সেতু বিভাগের সচিব করার পাঁয়তারা করছে একটি চক্র। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের প্রকাশ্য সমর্থমকারী এই কর্মকর্তাকে কেন এখনও ওএসডি বা বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়নি, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।
সেতু বিভাগের সচিব মোঃ ফাহিমুল ইসলাম গত ২৮ নভেম্বর সেতু বিভাগ হতে বদলি হয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে যোগদান করেন। এর পর থেকেই ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন সেতু বিভাগের অতিরিক্ত সচিব রশিদুল হাসান। বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, প্রায় তিন সপ্তাহ সচিবের রুটিন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকের সান্নিধ্য লাভ করেছেন এই কর্মকর্তা। যদিও এর আগে তিনি ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এবং স্বৈরাচার শেখ হাসিনার আস্থাভাজন ওবায়দুল কাদেরের খুব কাছের লোক ছিলেন।
জানা গেছে, নোয়াখালীতে ওবায়দুল কাদেরের বাড়ির কাছেই রশিদুল হাসানের বাড়ি। ছাত্র জীবন থেকেই ওবায়দুল কাদেরের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল বলেও জানা গেছে। মূলত ছাত্রাবস্থা থেকেই ওবায়দুল কাদেরের গ্রামের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল রশিদুল হাসানের। ক্ষমতায় থাকাকালে ওবায়দুল কাদেরই তাকে সেতু বিভাগে যুগ্মসচিব হিসেবে পদায়নে সুপারিশ করেছিলেন। সূত্র বলছে, অফিস সময়ের পরে ওবায়দুল কাদেরের বাসায় ছিল তার অবাধ যাতায়াত।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, চলতি বছরের ২৪ এপ্রিল বিসিএস ১৮তম ব্যাচের সাথে পতিত সরকারের অত্যন্ত ঘনিষ্ট এবং আস্থাভাজন কর্মকর্তা হিসেবে তিনি অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেছেন। অতিরিক্ত সচিব হিসেবে সবমিলিয়ে তিনি আট মাস যাবত কাজ করছেন।
যদিও ১৮তম ব্যাচের সাথে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে কোনো কর্মকর্তাই এখনও পর্যন্ত সচিব হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেননি। এছাড়াও একই বিভাগে যুগ্মসচিব ও অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কাজ করার পর একই বিভাগে সচিব হিসেবে পদায়নের রেওয়াজ সিভিল সার্ভিসে নেই। তার মত ফ্যাসিস্ট সরকারের একজন দোসরের নাম সচিবের তালিকায় উঠে আসায় সিভিল প্রশাসনের সাধারণ সদস্যগণ হতাশা প্রকাশ করেছেন।
সূত্র জানায়, ফ্যাসিস্ট সরকারের সাথে সুসম্পর্ক থাকায় তিনি দীর্ঘ ৫ বছর ধরে সেতু বিভাগে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন। ঐ সময়ে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার ভয়ে তটস্থ ছিলেন। সেই সুবাদে বিদেশ ভ্রমণ তার জন্য ছিল নিয়মিত ঘটনা। সেতু বিভাগের সবচেয়ে ক্ষমতাধর এবং সুবিধাভোগী কর্মকর্তা হিসেবে তিনি ওই সময় পরিচিতি পান। ওই সময় তার কথা না শোনায় অনেকেই শাস্তিমুলক বদলির শিকার হয়েছেন বলেও প্রমাণ রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে সেতু বিভাগ থেকে অবৈধ সুবিধা নেওয়ারও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রশিদুল হাসানের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ৫ আগস্ট এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পরপরই পতিত সরকারের আমলে দানব বনে যাওয়া এই কর্মকর্তা হঠাৎই নিজেকে আড়াল করে ফেলেন। ফ্যাসিস্ট সরকারের রয়ে যাওয়া দোসরদের সহায়তায় ভোল পালটে সেতু বিভাগেই রয়ে যান। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের পর ফ্যাসিস্ট সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠতার কারণে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/ বিভাগের অনেক কর্মকর্তাকে তাৎক্ষণিকভাবে ওএসডি বা বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হলেও তার স্বভাবসুলভ চাটুকারিতার কারণে তিনি বহাল তবিয়তে আছেন।
তিনি যুগ্মসচিব হিসেবে সেতু বিভাগে চাকুরিকালে তৎকালীন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সাথে সখ্যতার কারণে অসংখ্যবার ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব অবৈধভাবে লাভ করেন। অতিরিক্ত সচিব হিসেবে বিসিএস ১৮ ব্যাচের সাথে পদোন্নতি লাভ করার সাথে সাথে সচিব হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। সচিবের রুটিন দায়িত্বের বদৌলতে বর্তমান উপদেষ্টার নিকট নিজের সম্পর্কে মিথ্যা, অসত্য এবং বানোয়াট তথ্য উপস্থাপন করে তার আস্থাভাজন হয়ে উঠেন। ফলে একদিকে যেমন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিতর্কিত করার জন্য অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন অন্যদিকে, পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপর হয়ে উঠেছেন।
বিভাগীয় বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, সেতু বিভাগে সচিব নিয়োগের জন্য সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা মৌখিকভাবে একটি মানদণ্ড (ক্রাইটেরিয়া) নির্ধারণ করেছেন। ঐ ক্রাইটেরিয়া অনুযায়ী একজন অতিরিক্ত সচিব এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে বিবেচনায় নিয়ে সচিব নিয়োগ করার মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছেন। সে অনুযায়ী সেতু বিভাগের সচিব নিয়োগের জন্য চার জনের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। সেখানে ১১ ব্যাচের সিনিয়র কর্মকর্তাকে প্রাধান্য না দিয়ে জুনিয়র কর্মকর্তা মোঃ রশিদুল ইসলাম (সিরিয়াল ০৩ নম্বর) সচিব করার নীলনকশা বাস্তবায়নের অপচেষ্টা চলছে।
দীর্ঘ দিনের রেওয়াজ অনুযায়ী প্রশাসনে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে সচিব নিয়োগ করা হয় না। তাই সচিব নিয়োগের জন্য প্রশাসনে সেই ধারাবাহিকভাবে ভেঙে ফেললে প্রশাসনে আবারও অস্থিরতা সৃষ্টির ঝুঁকি রয়েছে। এ অবস্থায় প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়বে বলে শঙ্কা জানিয়েছেন সিভিল প্রশাসনের সাধারণ সদস্যরা। একই সাথে পতিত সরকারের সাথে রশিদুল হাসানের ঘনিষ্ঠতার বিষয়টিকে আমলে নিয়ে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়ারও জোর দাবি তাদের। পতিত সরকারের সাথে এত ঘনিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও তাকে কেন এখনও ওএসডি বা বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়নি, তা নিয়ে সকলের মধ্যে সীমাহীন কৌতুহলের সৃষ্টি হয়েছে।