বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশে জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব ক্রমেই গভীর এবং বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং অর্থনৈতিক কাঠামোর কারণে ভবিষ্যতে এই আঘাত মহাদুর্যোগ আকারে আঘাত হানতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন গবেষকরা। ২০১৪ সালের কথাই ধরা যাক; সেপ্টেম্বরে হঠাৎ করেই আঘাত হানলো ভয়াবহ বন্যা। পূর্ব-দক্ষিণাংশের জেলা সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার কোথাও কোথাও চব্বিশ ঘন্টার ব্যবধানে পনি বেড়েছে ৭ থেকে ৮ ফুট পর্যন্ত। এসব ভারতের সীমান্ত জেলা। ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ত্রিদেশীয় কয়েকটি নদী তীরবর্তী।
বাংলাদেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে ওই এলাকায় এতো বড় বন্যা আর হয়নি। দু সপ্তাহ স্থায়ী এই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ। মারা গেছে দেড়’শরও বেশি মানুষ। আর্থিক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বাংলাদেশে এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য সরাসরি জলবায়ুর পরিবর্তনকে দায়ী করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো। তারা বলছে, ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টিতে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। পানি এতো দ্রুত বেড়েছে যে কোনো ধরনের প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগই পায়নি উপদ্রুত এলাকার মানুষ। দুর্গতরা অনেকেই বলেছেন সেখানে ‘সচরাচর বন্যা হয় না’। অথচ এবার দোতালা বাড়ি পর্যন্ত ডুবে গেছে। পুরোপুরি যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে গেছে অন্তত দেড়’শ বর্গ কিলোমিটার এলাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে অতিবৃষ্টি একটি বড় কারণ হলেও এর বাইরে আরও কিছু উপাদান এবারের বন্যার পেছনে কাজ করছে। যেমন, নদীর পানি বহনের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়া। বাংলাদেশের ওই অঞ্চলের নদীগুলোর নাব্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মেঘালয় বা আসাম থেকে আসা বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি নদী পথে হাওর থেকে বের হয়ে মেঘনা বা যমুনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যেতে পারছে না। সেই পানিই তলিয়ে দিয়েছে ৬ জেলার ৬০ লাখ মানুষের জনবসতিকে। অক্টোবরেও বন্যা হয়েছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা শেরপুর-ময়মনসিংহে। গারো পাহাড়ে ঘেরা ওই এলাকাটিতেও এর আগে বন্যা হয়নি। সেখানেও অবিশ্বাস্যভাবে এক রাতে পানি বেড়েছে ১৫ ফুট পর্যন্ত।
পরিস্থিতি দেখে জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন অভিজ্ঞতা এবারই প্রথম বাংলাদেশের। বন্যামুক্ত এলাকাগুলো তলিয়ে যাচ্ছে । নতুন নতুন দুর্যোগ আঘাত হানছে সেসব এলাকায় যেখানে নদী ভরাট হয়েছে, বন জঙ্গল সাফ করে তৈরি হয়েছে প্রকল্প। তাহলে এসব কি প্রকৃতির প্রতিশোধ?
বিশ্বব্যাপী গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, বাংলাদেশেও তাপমাত্রা বাড়ছে। ১৯৭৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশে গড় তাপমাত্রা ১.২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে । যা প্রকৃতি মেনে নিতে পারছে না। অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে। শীত আসছে দেরীতে। গ্রীষ্ম ছড়াচ্ছে তীব্র তাপ প্রবাহ। যা কৃষি এবং জনস্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। ফসলের চক্র ভেঙে পড়েছে।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি মূলত গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের ফলে ঘটছে, যা মূলত শিল্পোন্নত দেশগুলোর কারণে। কিন্ত এর দায় মেটাচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, নেপাল এবং ভূটানের মতো দেশগুলো। প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের নতুন নতুন যেসব রূপ ফিরে আসছে তা শুধু উদ্বেগ নয়, আতংকেরও।
বিশ্বব্যাংক বলছে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে তৈরি হয়েছে এটি। ১৯৬১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর গড়ে ৩.৩ মিলিমিটার বেড়েছে। এখন বছরে বাড়ছে ৫ থেকে ৭ মিলিমিটার পর্যন্ত। সাগরের নোনা পানি লোকালয়ে চলে আসায় দেশের উপকুলী এলাকাগুলোতে অন্তত ৩০ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। ২৫০ সালেরমধ্যে ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তু হওয়ার আশংকা করছেন, বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীরা। যা দেশে দুর্ভিক্ষ কিংবা মহামারী তৈরি করতে পারে।
লেখক : এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্ট, সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেটচেঞ্জ জার্নালিষ্টস ফোরাম-SACCJF